আসসালামু আলাইকুম, প্রিয় ফলপ্রেমী বন্ধুগণ। আপনাদের সাথে আছি আমি মেহেদী শিমুল এবং আজকের আলোচনার বিষয় হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ফল অ্যাভোকাডোর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং উপকারিতা।
প্রায় সাত হাজার বছর আগে দক্ষিণ মেক্সিকো এবং কলম্বিয়াতে এই ফলটির উৎপত্তি হয়েছে। অ্যাভোকাডোর বৈজ্ঞানিক নাম হল Persea Americana.
অ্যাভোকাডো ফলের বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাসঃ
- Kingdom: Plantae
- Phylum: Angiosperms
- Class: Eudicots
- Order: Laurales
- Family: Lauraceae
- Genus: Persea
- Species: Persea Americana.
পুরো বিশ্বে অনেক জাতের অ্যাভোকাডো রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি জাত হচ্ছে-
- Hass Avocado
- Fuerte Avocado
- Bacon Avocado
- Pinkerton Avocado
- Zutano Avocado
এদের মধ্যে Hass Avocado সবথেকে জনপ্রিয় যা পুষ্টির দিক থেকেও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
অ্যাভোক্যাডো ফলের রয়েছে অনেক উপকারীতা। চলুন জেনে নেওয়া যাক অ্যাভোক্যাডো ফলের সেইসব উপকারীতা সম্পর্কেঃ
১. পুষ্টি উপাদানঃ
অ্যাভোক্যাডো আকার এবং রঙে বিভিন্ন রকমের হয় – নাশপাতি আকৃতির থেকে গোলাকার এবং সবুজ থেকে কালো পর্যন্ত। এগুলি ৪০০ গ্রাম থেকে ১৪০০ গ্রাম পর্যন্ত হতে পারে। এই ফলের আকৃতি এবং অ্যালিগেটরের মতো সবুজ রঙের জন্য এটি “অ্যালিগেট পিয়ার্স” নামেও পরিচিত।
এই ফলের অভ্যন্তরীণ হলুদ-সবুজ মাংসল অংশ খাওয়া হয়, তবে খোসা এবং বীচি ফেলে দেওয়া হয়। এতে ২০ রকমের ভিটামিন এবং খনিজ সহ বিভিন্ন ধরণের পুষ্টি উপাদান রয়েছে। একটি ১০০ গ্রাম অ্যাভোক্যাডোতে রয়েছে-
- ভিটামিন কেঃ ২৬%
- ফোলেটঃ ২০%
- ভিটামিন সিঃ ১৭%
- পটাশিয়ামঃ ১৪%
- ভিটামিন বি-৫ঃ ১৪%
- ভিটামিন বি-৬ঃ ১৩%
- ভিটামিন ইঃ ১০%
এছাড়াও এতে স্বল্প পরিমাণে ভিটামিন এ, বি-১ (থায়ামিন), বি-২ (রিবোফ্লাভিন) এবং বি-৩ (নিয়াসিন) সহ ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, তামা, আয়রন, দস্তা এবং ফসফরাস রয়েছে।
এই ফলে রয়েছে ১৬০ ক্যালরি শক্তি, ২ গ্রাম প্রোটিন এবং ১৫ গ্রাম পরিমাণ স্বাস্থ্যকর ফ্যাট। এতে ৯ গ্রাম কার্বস যার মধ্যে ৭ টি ফাইবারযুক্ত এবং বাকি ২টি নেট কার্বস থাকায় এটি লো-কার্বস ফ্রুট হিসাবেও পরিচিত। অ্যাভোক্যাডোতে কোনো কোলেস্টেরল বা সোডিয়াম থাকে না এবং স্যাচুরেটেড ফ্যাট কম থাকে।
২. পটাশিয়াম সমৃদ্ধঃ
অ্যাভোক্যাডোতে পটাশিয়ামের পরিমাণ খুব বেশি। একটি ১০০-গ্রাম ওজনের কলাতে ১০% এবং অ্যাভোক্যাডোতে ১৪% পটাশিয়াম থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, উচ্চ পটাশিয়াম রক্তচাপ হ্রাস করে যা হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এবং কিডনি ফেইলিউরের ঝুঁকি কমায়।
৩. মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধঃ
অ্যাভোক্যাডো একটি উচ্চ ফ্যাটযুক্ত খাবার। প্রকৃতপক্ষে, এতে থাকা ক্যালোরিগুলির ৭০% আসে ফ্যাট থেকে। তবে এগুলিতে কোনও চর্বি থাকে না। অ্যাভোক্যাডোতে থাকা বেশিরভাগ ফ্যাট হলো অলিক অ্যাসিড অর্থাৎ মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড যা অলিভ অয়েলের প্রধান উপাদান। অলিক অ্যাসিড জ্বালাপোড়া কমাতে এবং ক্যান্সার কোষ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। অ্যাভোক্যাডোতে থাকা ফ্যাটগুলি অনেকটা তাপ বিরোধী হওয়ায় এর তেল রান্নার জন্য বেশ স্বাস্থ্যকর এবং নিরাপদ।
৪. উচ্চ ফাইবার সমৃদ্ধঃ
অ্যাভোক্যাডোতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে যা এমন একটি পুষ্টি উপাদান যার প্রভাবে মানব দেহের ওজন মাত্রাতিরিক্ত হতে পারে না, রক্তে শর্করার স্পাইকগুলি হ্রাস পায় এবং সাথে আরো অনেক রোগের ঝুঁকি কমে। প্রতি ১০০-গ্রাম অ্যাভোক্যাডোতে ৭ গ্রাম ফাইবার থাকে, যা RDA এর ২৭%। অ্যাভোক্যাডোতে থাকা প্রায় ২৫% ফাইবার দ্রবণীয় এবং ৭৫% অদ্রবণীয়।
৫. কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইড স্তরকে কমিয়ে দেয়ঃ
কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইডস, রক্তচাপ হৃদরোগের প্রধান কারণ। বহু গবেষণায় এইসকল ঝুঁকির উপর অ্যাভোক্যাডোর প্রভাব পরীক্ষা করে দেখা গেছে-
- কোলেস্টেরলের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে।
- ২০% পর্যন্ত রক্তের ট্রাইগ্লিসারাইড হ্রাস করে।
- এলডিএল কোলেস্টেরল ২২% পর্যন্ত কমিয়ে আনে।
- এইচডিএল কোলেস্টেরল যেটা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী সেটার পরিমাণ ১১% পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়।
৬. সুস্বাস্থ্যের জন্য অ্যাভোকাডোঃ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকদের করা একটি জরিপে অংশ নেওয়া ১৭,৫৬৭ জন অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে অ্যাভোক্যাডো গ্রাহকরা অনেক স্বাস্থ্যবান ছিলেন। তাদের পুষ্টির পরিমাণ অনেক বেশি ছিল এবং বিপাকীয় সিনড্রোম হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় অর্ধেক ছিল, যা হৃদরোগ এবং ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। যে সকল ব্যক্তি নিয়মিত অ্যাভোক্যাডো খেয়েছিলেন তাদের ওজন কম ছিল, বিএমআই কম ছিল এবং পেটের মেদও অনেক কম ছিল। তাদের এইচডিএল অর্থাৎ স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী কোলেস্টেরলের পরিমাণ ও ছিলো অনেক বেশি।
৭. পুষ্টি শোষণে সহায়তাকারী ফ্যাট সমৃদ্ধঃ
মানবদেহের কিছু পুষ্টিগুণ ব্যবহারের জন্য তাদের ফ্যাটের সাথে একত্রিত করা প্রয়োজন। অ্যাভোক্যাডোতে ফ্যাট-দ্রবণীয় ভিটামিন এ, ডি, ই, কে এবং পাশাপাশি ক্যারোটিনয়েডের মতো এন্টিঅক্সিড্যান্টও রয়েছে যা দেহের পুষ্টি শোষণে সহায়তা করে। সুতরাং, অ্যাভোক্যাডো কেবল উচ্চ পুষ্টিকরই নয়, এটি অন্যান্য সকল খাবারের পুষ্টির মান চমৎকারভাবে বাড়িয়ে তুলতে পারে।
৮. শক্তিশালী এন্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধঃ
অ্যাভোক্যাডো শুধুমাত্র অন্যান্য খাবার থেকে এন্টিঅক্সিডেন্ট শোষণের ক্ষমতাই বাড়িয়ে তোলে না, বরং এটি উচ্চ মাত্রায় এন্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধও বটে। এর মধ্যে রয়েছে ক্যারোটিনয়েডস লুটেইন এবং জেক্সানথিন, যা চোখের স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বয়স্কদের ছানি এবং ম্যাকুলার অবক্ষয় একটি সাধারণ ব্যাপার, যেগুলি প্রতিরোধে অ্যাভোক্যাডো সহায়তা করতে পারে।
৯. ক্যান্সার প্রতিরোধীঃ
ক্যান্সার চিকিৎসা এবং এর প্রতিরোধে অ্যাভোক্যাডো যথেষ্ট উপকারী। গবেষণালব্ধ ফলাফলের উপর ভিত্তি করে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে, এটি মানব লিম্ফোসাইটে কেমোথেরাপির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হ্রাস করতে সহায়তা করতে পারে। এছাড়াও অ্যাভোক্যাডো প্রোস্টেট ক্যান্সার কোষগুলির বৃদ্ধিতেও বাধা দেয়।
১০. এক্সট্র্যাক্ট বাতরোগ থেকে মুক্তিতে সহায়তাকারীঃ
আর্থ্রাইটিস মানবদেহের একটি সাধারণ ব্যাধি। এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা যা মানুষের সারা জীবন ধরে থাকে। বহু গবেষণায় দেখা গেছে যে অ্যাভোক্যাডো এবং সয়াবিন তেল এক্সট্র্যাক্ট অস্টিওআর্থ্রাইটিস হ্রাস করতে বিশেষভাবে সহায়তা করে।
১১. রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণঃ অ্যাভোকাডোতে থাকা ফাইবার এবং স্বাস্থ্যকর চর্বিগুলি রক্তে শর্করার মাত্রা স্থিতিশীল করতে সাহায্য করতে পারে, যা ডায়াবেটিস বা এই অবস্থা বৃদ্ধির ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের জন্য উপযুক্ত খাদ্য।
১২. হাড় মজবুত করেঃ অ্যাভোকাডোতে ভিটামিন কে রয়েছে, যা হাড়ের গঠন মজবুত রাখার জন্য অপরিহার্য কারণ এটি ক্যালসিয়াম শোষণ এবং হাড়ের খনিজ উপাদান বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
১৩. ত্বকের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিতে সহায়তাকারীঃ অ্যাভোকাডোতে থাকা ভিটামিন ই এবং সি ত্বকের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে। এগুলি মানুষের ত্বককে UV রশ্মির ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে, বার্ধক্যের লক্ষণগুলি কমাতে সহায়তা করতে পারে।
১৪. ওজন কমাতে সহায়তাকারীঃ
গবেষণায় দেখা গেছে, খাবারের সাথে অ্যাভোক্যাডো খেলে ২৩% বেশি তৃপ্তি পাওয়া যায় এবং যারা এই ফলটি খান না তাদের তুলনায় পরবর্তী ৫ ঘন্টায় তাদের খাওয়ার ইচ্ছা ২৮% কম হয়। ডায়েটে অ্যাভোক্যাডো অন্তর্ভুক্ত করলে এটি স্বাভাবিকভাবেই কম ক্যালোরি খেতে সহায়তা করবে এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত করবে। অ্যাভোক্যাডো উচ্চ ফাইবার এবং নিম্ন কার্বস বিশিষ্ট হয়ে থাকে, যা ওজন হ্রাসের প্রক্রিয়াকে সহজ করে তোলে।
১৫. ডায়েট লিস্টের কার্যকরী খাবারঃ
অ্যাভোক্যাডো শুধুমাত্র একটি স্বাস্থ্যকর খাবারই নয়, এগুলি যথেষ্ঠ সুস্বাদু এবং বিভিন্ন ধরণের খাবারের সাথেও খাওয়া যায়। সালাদ এবং বিভিন্ন রেসিপিতে যুক্ত করে খাওয়া যায় এই ফলটি। কেননা এর একটি ক্রিমি ও চর্বিযুক্ত গঠন রয়েছে যা অন্যান্য উপাদানগুলির সাথে ভালভাবে মিশ্রিত হতে পারে।
অ্যাভোক্যাডো ফল খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতাঃ
অ্যাভোক্যাডো ফলের এতো এতো উপকারীতার অর্থ হচ্ছে এতে প্রচুর পরিমাণে শক্তি জমা আছে। সুতরাং, এই ফল খাওয়ার ক্ষেত্রেও তাই মেনে চলা উচিৎ বিশেষ সতর্কতা। গবেষণা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী একজন ব্যক্তিকে একদিনে একটি পূর্ণাংগ অ্যাভোক্যাডো ফলের কেবল অর্ধেক পরিমাণে খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। এতে করে সেটা ব্যক্তির শরীরের চাহিদার সাথে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে সহজে।
তাছাড়া, কখনই খালি পেটে এই ফল খাওয়া উচিৎ নয়। কারণ, অতিরিক্ত শক্তি থাকার কারণে এই ফল খালি পেটে খেলে পেটে গ্যাসট্রিক জনিত ব্যাথা হতে পারে।
প্রিয় ফলপ্রেমী বন্ধুরা, আজ এই পর্যন্তই। সকলের জন্য শুভ কামনা জানিয়ে এখানেই শেষ করছি। ভালো থাকবেন সবাই। আসসালামু আলাইকুম।